আর্জেন্টিনার সর্বশেষ বৈশ্বিক শিরোপা ১৯৮৬ সালে দিয়েগো ম্যারাডোনার হাত ধরে। মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট কোপা আমেরিকার সর্বশেষ শিরোপা আর্জেন্টাইনরা ঘরে তুলতে পেরেছিল ১৯৯৩ সালে। সেটা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার হাত ধরে। এরপর হতাশা আর আক্ষেপের গল্পটাই
বেশী। কাঁদতে হয়েছে অনেকবার। নিঃশ্বাস দূরুত্বে কয়েকবার দেখেছে তারা শিরোপাও। তবে চুমু খাওয়া হয়নি। ট্রফি উঁচিয়ে ধরে উল্লাস করাটা যেন দূর অতীতের গল্প। বরং বারবার রানার্স আপের যন্ত্রনায় কাতর ছিল লাতিন আমেরিকার এই দেশটি। কাতর
চোখে দেখেছে তারা ঝলমলে কনফেত্তির মধ্যে প্রতিপক্ষের শিরোপা জয়ের উল্লাস। এভাবে আর কত?
আক্ষেপের শুরুটা ম্যারাডোনা দিয়েই। সর্বশেষ হতাশার নায়ক লিওনেল মেসি। ১৯৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির কাছে হেরেছিল ম্যারাডোনা শিবির। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে সেই জার্মানি আবারো কাঁদালো মেসি বিগ্রেডকে। দীর্ঘ দুই যুগের বিশ্বকাপ ফাইনালের এই হতাশার মেলবন্ধন, কজনাই বা চেয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৯০
বিশ্বকাপ বাদ দিন। আর্জেন্টিনা বৈশ্বিক কিংবা মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা জিতেছে আজ থেকে ২৩
বছর আগে, ১৯৯৩ সালে বাতিস্তুতার হাত ধরে। এরপর আর্জেন্টাইনদের শোকসটা যেন ধূ ধূ বালুচর।
যেখান থেকে উঠছে হতাশার তপ্ত নিঃশ্বাস, শিরোপা বন্ধাত্ম ঘুঁচানোর তীব্র আকুলতা।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের ফাইনালে গিয়েও হয়নি। এক বছর পর
কোপা আমেরিকার ফাইনালেও ব্যর্থতার সাতকাহন। টাইব্রেকারে স্বাগতিক চিলির কাছে হার। এরপর এক বছর পর
শতবর্ষী কোপা টুর্নামেন্টে আবারো ফাইনালে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ গতবারের ফাইনালিস্ট সেই চিলি। যুক্তরাষ্ট্রের মেটলাইট স্টেডিয়ামে শিরোপা নির্ধারণী এই ম্যাচটি শুরু
হবে বাংলাদেশ সময় সোমবার ভোর ছয়টায়।
দুরন্ত আর্জেন্টিনার সামনে গতবারের ফাইনালিস্ট চিলি। স্বভাবতই, আর্জেন্টিনার সামনে উঠে আসছে প্রতিশোধ নামক শব্দটি। তবে কোচ জেরার্ডো মার্টিনো কিংবা অধিনায়ক লিওনেল মেসি তেমনটি ভাবতে নারাজ। তাদের চোখে প্রতিশোধ নয়, কিভাবে শিরোপা জেতা যায়, সেটাই সবার মনে বাজছে পুরোদমে। এক কাঠি এগিয়ে
মেসি। উল্টো চিলি সম্পর্কে সতীর্থদের সাবধান করে দিয়েছেন তিনি, ‘আমরা চিলিকে চিনি, এরা নিখুঁত একটি দল, এ কারণেই আবার
ফাইনালে উঠেছে তারা।’
যদিও এই চিলিকেই চলতি
টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনা হারিয়েছিল ২-১ গোলে।
যে ম্যাচে ইনজুরির কারণে ছিলেন না তুরুপের তাস
লিওনেল মেসি। যিনি এই মুহূর্তে রয়েছেন
ফর্মের তুঙ্গে। হ্যাটট্রিকসহ পাঁচ গোল করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা মেসি। তবে আর্জেন্টাইন ভক্তদের আতঙ্কের বিষয় হলো, ছয় গোল নিয়ে
সর্বোচ্চ গোলদাতা কিন্তু চিলির এডুয়ার্দো ভার্গাস।
দলগত হিসাবে টিম আর্জেন্টিনার যে স্পিরিট, তাতে
আশার সঞ্চার হতেই পারে সমর্থক-ভক্তদের। টুর্নামেন্টে এখন পর্যন্ত প্রতিটি ম্যাচেই জিতেছে আর্জেন্টিনা। পাঁচ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে তারা পাঠিয়েছে ১৮টি গোল। হজম করেছে মাত্র দুটি। এজন্যই কি, মেসি আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরাই হব চ্যাম্পিয়ন।’
গ্রুপ পর্বে টানা তিন জয়। ১০ গোলের বিপরীতে
এক গোল হজম। কোয়ার্টার ও সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা
যেন আরও বিধ্বংসি। ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে ৪-১ গোলে
জয়ের পর সেমিতে যুক্তরাষ্ট্রের
বিরুদ্ধে ৪-০। নিখাদ
পারফরম্যান্স। কিন্তু ফাইনালে উঠলেই আর্জেন্টিনার কি জানি হয়ে
যায়, সেই রোগ এবারও দেখা যাবে না তো?
অন্যদিকে চিলি গ্রুপ রানার্স আপ হিসাবে কোয়ার্টার
ফাইনালে উঠেই দেখিয়েছিল তাদের ভয়ংকর রূপ। যেখানে মেক্সিকোর সঙ্গে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে ভার্গাস-সানচেজরা। চিলি জিতেছিল ৭-০ গোলের
বড় ব্যবধানে। সেমিতে কলম্বিয়ার সঙ্গে ২-০ গোলের
রোমাঞ্চকর জয়। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জয়টিই ফাইনালের আগে চিলিকে উজ্জীবিত করছে পুরোদমে।
হেড
টু হেডের পরিসংখ্যানে স্বস্তি পেতেই পারে আর্জেন্টিনা। যেখানে ৮৭ ম্যাচের মধ্যে
৫৮টিতে জয় আর্জেন্টিনার। চিলির
মাত্র জয় ৬টিতে। বাকি
২৩ ম্যাচ ড্র। র্যাংকিং যদিও
মাঠের খেলায় আনা বোকামি, তারপরও ফিফা র্যাংকিংয়ে এক
নম্বর অবস্থান আর্জেন্টিনাকে সাহস যোগাচ্ছে। যেখানে পাঁচ নম্বরে রয়েছে চিলিও।
তবে ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনার মূল শংকা চোট। যেখানে খেলা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়ার। অ্যাডাক্টর
মাংসপেশির চোটে পড়া মারিয়া গত বৃহস্পতিবার অনুশীলনে
ফিরলেও পুরো সেশন শেষ করতে পারেননি। বাঁ কনুইয়ের রেডিয়াল হাড়ে চিড় ধরায় খেলতে পারবেন না ফরোয়ার্ড লাভেজ্জি।
ফরোয়ার্ড নিকোলাস গাইতানের সঙ্গে চোটে ভুগছেন ডিফেন্ডার মার্কোস রোহো ও মিডফিল্ডার ফার্নান্দেসও।
মেসির সঙ্গে তাই ভরসা গঞ্জালো হিগুয়েন ও সার্জিও অ্যাগুয়েরো।
অবশ্য ইনজুরি ঝামেলা পাকাতে পারে চিলি শিবিরেও। হাঁটুর চোটে পড়া মিডফিল্ডার পাবলো হার্নান্দেজ ও টুর্নামেন্টের অন্যতম
সেরা মিডফিল্ডার মার্সেলো দিয়াসের খেলা নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। তবে অধিনায়ক ক্লদিও ব্রাভোর সঙ্গে গারি মেদেল, আর্তুরো ভিদাল, আলেক্সিস সানচেজ সমৃদ্ধ এই দলটি শিরোপা
জিততে সক্ষম বলে মনে করছেন চিলির কোচ জুয়ান অ্যান্টোনিও পিজ্জি। ফাইনাল ম্যাচের আগে তার কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়, ‘আমরা খুব ভালো অবস্থায় ফাইনালে এসেছি। আমরাও বেশ শক্তিশালী। তাদের (আর্জেন্টিনা) অবশ্যই প্রতিপক্ষকে সমীহ করতে হবে’।
অন্যদিকে প্রায় দুই যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটাতে সতীর্থদের শতভাগ পারফরম্যান্স দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি। যে করেই হোক,
ট্রফিটা জিততে মরিয়া বার্সেলোনার এই সুপার স্টার।
তিনি বলেছেন, ‘সবাইকে বলব, সেরাটা ঢেলে দাও। শিরোপার খুব কাছাকাছি আমরা। ম্যাচ শেষে ট্রফিটা যেন আমাদেরই হয়’।
শতবর্ষী কোপার ফাইনালে শেষটা কী হবে, তা
ফুটবল বিধাতাই ভালো জানেন। শিরোপার জন্য লড়াই হবে তুমুল, উত্তেজক ও রোমাঞ্চকর, তা
অনুমেয়। ট্রফি শেষ পর্যন্ত কার হাতে শোভা পাবে, লিওনেল মেসি না ক্লদিও ব্রাভো,
তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে সোমবার ভোর পর্যন্ত।